বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অনেক গভীর ও বৈচিত্র্যপূর্ণ, যার শিকড় গেঁথে আছে প্রাচীন ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষার ধারায়। আদি যুগের বাংলা সাহিত্য শুধুমাত্র ভাষার বিকাশ নয়, বরং তখনকার সমাজ, ধর্মবিশ্বাস ও জীবনদর্শনের প্রতিফলনও বয়ে এনেছে। এই সময়কার সাহিত্যচর্চায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল স্পষ্ট, বিশেষ করে মহাযান ও বজ্রযান বৌদ্ধধারার অন্তর্গত সহজিয়া দর্শনে। চর্যাপদের গানে যেমন মেলে আধ্যাত্মিকতার রহস্যময়তা, তেমনই ধরা পড়ে সেই সময়কার বাংলার সমাজচিত্র ও কাব্যিক সূচনালিপি। এই নিবন্ধে আমরা গভীরভাবে অন্বেষণ করবো বাংলা সাহিত্যের আদি যুগ এবং কীভাবে বৌদ্ধ প্রভাব সেই সাহিত্যধারাকে রূপ দিয়েছে নতুন এক পরিচয়ে।
চর্যাপদ : বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে চর্যাপদ সর্বাধিক স্বীকৃত। এটি একটি বৌদ্ধ দোহা-সংকলন যা পাল রাজবংশের শাসনামলে রচিত হয়েছিল। চর্যাপদে ব্যবহৃত ভাষা প্রাচীন বাংলার আদিরূপ, যার অস্তিত্ব প্রথম স্বীকার করেন ভাষাবিদ ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষারই আদিরূপ।”
চর্যাপদ রচিত হয়েছিল মূলত সন্ধ্যা ভাষায় এবং বৃত্ত ছন্দে। এই গানের ভাষা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হলেও তার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য গভীর। চর্যাপদের ব্যাখ্যা করেন এক বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার মুনিদত্ত, যিনি ‘টীকা’ প্রদান করে এই গীতিকবিতাগুলিকে ব্যাখ্যা করেন।
প্রধান কবিগণ ও তাঁদের অবদান:
- কাহ্নপা – সর্বাধিক পদ রচয়িতা (১৩টি পদ)
- সুসুকুপা – ৮টি পদ
- তন্ত্রীপা – পদসংখ্যা উল্লেখযোগ্য
- কুক্কুরীপা – অনেক গবেষক মনে করেন, তিনি চর্যাপদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি
কিছু উল্লেখযোগ্য পদ:
- পদ ২৪ (কাহ্নপা রচিত)
- পদ ২৫ (তন্ত্রীপা রচিত)
- পদ ৪৮ (কুক্কুরীপা রচিত)
- পদ ২৩-এর অর্ধেক অংশ (কুক্কুরীপা’র অংশ বলেই ধরে নেওয়া হয়)
চর্যাপদে পাওয়া যায় ৬টি প্রবাদ বাক্য, যা বাংলা সাহিত্যের সূচনালগ্নে ভাষার রূপ ও কাঠামো সম্পর্কে ধারণা দেয়।
বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাজন
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে সাধারণত তিনটি যুগে ভাগ করা হয়:
- প্রাচীন যুগ (আদি যুগ): ৯৫০ – ১২০০ খ্রিস্টাব্দ
- মধ্যযুগ: ১২০১ – ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ
- আধুনিক যুগ: ১৮০১ – বর্তমান সময়
অনেক পণ্ডিত যেমন ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান, এবং ভূদেব চৌধুরী এই বিভাজনকে সমর্থন করেন।
পাল রাজবংশ ও সাহিত্যের প্রসার
চর্যাপদের রচনাকাল ছিল পাল রাজবংশের শাসনামলে, যখন বাংলায় বৌদ্ধ ধর্ম ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। এই রাজবংশ প্রায় ৪০০ বছর (৭৫০–১১৬২ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলা শাসন করে।
পাল রাজাদের তালিকা (সংক্ষিপ্তভাবে):
- গোপাল (৭৫০–৭৭০)
- ধর্মপাল (৭৭০–৮১০)
- দেবপাল (৮১০–৮৫০)
- বিগ্রহপাল, শূরপাল, মহীপাল, রামপাল ইত্যাদি
- কুমারপাল (১১৩০–১১৪০)
- তৃতীয় গোপাল, মদনপাল
- সর্বশেষ রাজা: গোবিন্দপাল (১১৫২–১১৬২)
এই সময়কালেই বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতায় সাহিত্য, দর্শন, শিল্প ও স্থাপত্যের প্রসার ঘটে। পাল আমলের বিখ্যাত বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র ছিল বিক্রমশীলা, নালন্দা ও সোমপুর মহাবিহার।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ও বিস্তার
পাল রাজাদের সময় বাংলায় বৌদ্ধ ধর্ম ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠা পায়। পালির বৌদ্ধ সাহিত্য, দোহা ও চর্যাগান প্রমাণ করে বৌদ্ধদের সাহিত্যিক প্রভাব কতটা গভীর ছিল।
বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে যেসব কারণ উল্লেখযোগ্য:
- গৌতম বুদ্ধের আদর্শের প্রচার
- সম্রাট অশোকের ধর্মপ্রচারে সহায়তা
- পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা
- বহু বৌদ্ধ বিহার ও পীঠস্থান প্রতিষ্ঠা
আজকের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে প্রাপ্ত উয়ারী-বটেশ্বর, মাহাস্থানগড়, পাহাড়পুর প্রভৃতি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো বৌদ্ধদের উপস্থিতি ও সংস্কৃতি প্রকাশ করে।
বঙ্গদেশের ইতিহাস ও বৌদ্ধ প্রভাব
বাংলা একাধিক জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে গঠিত – যেমন: আদি অস্ট্রেলীয়, মঙ্গোলীয়, আর্য, শক, হুন, তুর্কি, মুঘল, ইত্যাদি। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীগুলোর ইতিহাসের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব জড়িয়ে আছে। ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় তার গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৪৯৪–৪৯৬) এই বিষয়টি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
উপসংহার
বাংলা সাহিত্যের আদি রূপ গঠনে চর্যাপদ ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বৌদ্ধ ধর্ম এবং পাল রাজবংশের শাসনকাল এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই পর্বে সাহিত্যের ভাষাগত বৈচিত্র্য, আধ্যাত্মিক ভাবধারা এবং ধর্মীয় অনুশীলনের প্রতিচ্ছবি প্রকাশ পেয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বুঝতে হলে চর্যাপদ এবং পাল রাজবংশের অবদান অবশ্যই জানার প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলা সাহিত্য : আদি যুগ ও বৌদ্ধ প্রভাব
বাংলা সাহিত্যের আদি যুগ বলতে কী বোঝায়?
বাংলা সাহিত্যের আদি যুগ বলতে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে বোঝায়। এই সময়ে চর্যাপদ বা চর্যা গীতি ছিল বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন, যা মূলত বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের লেখা।
চর্যাপদ কী এবং এর গুরুত্ব কী?
চর্যাপদ হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম কবিতা বা গীতিকবিতার সংকলন। এটি মূলত ধর্মীয় ভাবনায় লেখা হলেও এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজচিত্র, ভাষার প্রাথমিক রূপ ও আধ্যাত্মিক ভাবনা। এটি বাংলা ভাষার বিকাশের ইতিহাসে এক অমূল্য সম্পদ।
বৌদ্ধ ধর্ম বাংলা সাহিত্যে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে?
বৌদ্ধ ধর্ম, বিশেষ করে মহাযান ও সহজিয়া ভাবধারা, বাংলা সাহিত্যের প্রারম্ভিক রচনাগুলিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। চর্যাপদে সেই বৌদ্ধ আধ্যাত্মিকতা, মানবিকতা এবং গূঢ় অর্থে ভরপুর সহজ বচন দেখা যায়, যা সাহিত্যিক ও দার্শনিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।
আদি বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য কী ছিল?
আদি বাংলা ভাষা ছিল তৎসম ও দেশজ শব্দে ভরপুর, যার গঠন ছিল প্রাচীন মাগধী প্রাকৃতের ধারায়। ভাষাটি ছিল সরল, প্রতীকী এবং অলংকারবর্জিত। চর্যাপদের ভাষা ‘সন্দোহবদ্ধ’ অর্থাৎ গূঢ় অর্থপূর্ণ হওয়ায় গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
চর্যাপদে সমাজের কী চিত্র ফুটে উঠেছে?
চর্যাপদের গানে প্রাচীন বাংলার কৃষক সমাজ, নারীচরিত্র, দারিদ্র্য, ধর্মীয় আচরণ এবং সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতিফলন পাওয়া যায়। তা ছাড়া সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের কথা ও তাদের জীবনসংগ্রামও চর্যাগীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে।